editor.timesmail24@gmail.com রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪
৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

৪৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর


প্রকাশিত: ২১ আগষ্ট ২০২৪, ১৯:৩৬
আপডেট: ২১ আগষ্ট ২০২৪ ১৯:০৮

দীর্ঘ এক যুগ ধরে ই-টেন্ডারিং পদ্ধতির দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এবং জাল সনদ জমা দিয়ে একচেটিয়া ঠিকাদারি করে আসছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা।

হাসিনার সরকারের আমলে তাঁরা জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে একচেটিয়া ঠিকাদারি কাজ পেয়েছেন। তদন্তে জালিয়াতির প্রমাণও মিলেছে। এরপর ৪৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকাভুক্ত করেছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এখন সরকার পরিবর্তনের পর এই জালিয়াতিতে যুক্ত ঠিকাদারেরা ফিরে আসার জন্য চাপ শুরু করেছেন।

গত রোববার তেজগাঁওয়ে সওজের প্রধান কার্যালয়ে এসব ঠিকাদার বিক্ষোভ করেন। এরপর প্রধান প্রকৌশলী বরাবর দেওয়া এক স্মারকলিপিতে ১০ দফা দাবি পেশ করেন তাঁরা। তিন কার্যদিবসের মধ্যে এসব দাবি বাস্তবায়িত না হলে সড়ক ভবন ঘেরাও করা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন ঠিকাদারেরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজ বুধবার সন্ধ্যা সাতটায় প্রধান প্রকৌশলী ঠিকাদারদের নিয়ে বৈঠক করবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

সওজের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, জালিয়াতির মাধ্যমে এক যুগ ধরে একচেটিয়া কাজ পাওয়া এসব ঠিকাদার নিজেদের বঞ্চিত হিসেবে উপস্থাপন করছেন। এমনকি যেসব কর্মকর্তা জালিয়াতি ধরে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তাঁদের বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের লোক হিসেবে চিহ্নিত করে চাপে রাখার কৌশল নিচ্ছেন। এসব ঠিকাদারের পেছনে সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পর্যায়ের বেশ কিছু কর্মকর্তাও রয়েছেন। মূলত এসব কর্মকর্তাই চিহ্নিত কিছু ঠিকাদারকে একচেটিয়া কাজ পেতে সহায়তা করেছেন। নিজেরাও সুবিধা নিয়েছেন।

সওজ সূত্র জানায়, প্রধান প্রকৌশলীর কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে নয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক সই করেছেন। গত এক যুগে যে ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সওজে সবচেয়ে বেশি কাজ পেয়েছে, এর মধ্যে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের মালিক স্মারকলিপিতে সই করেছেন। সেই প্রতিষ্ঠানগুলো হলো এনডিই, মাসুদ হাইটেক, রিলায়েবল বিল্ডার্স, এম এস সালেহ আহমেদ ও হাসান টেকনো। বাকি চারটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও গত এক যুগে সওজে বিপুল পরিমাণ ঠিকাদারি কাজ করেছে। এগুলো হলো সাগর ইনফো বিল্ডার্স, জে এন্টারপ্রাইজ, এম এ ইঞ্জিনিয়ারিং ও মো. খোরশেদুজ্জামান।

সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘ এক যুগ ধরে ই-টেন্ডারিং পদ্ধতির দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে এবং জাল সনদ জমা দিয়ে একচেটিয়া ঠিকাদারি করে আসছেন এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকেরা। প্রথম আলোতে গত বছরের ১৪ অক্টোবর ‘সড়কের ৫১% কাজ পেয়েছেন “প্রভাবশালীদের ঘনিষ্ঠ”৫ ঠিকাদার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সড়কে গুটিকয়েক ঠিকাদারের বেশির ভাগ কাজ পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গত বছরের ৬ নভেম্বর উচ্চ আদালতে একজন আইনজীবী রিট আবেদন করেন।

আদালতের নির্দেশে গত ১৯ নভেম্বর সওজ তদন্ত কমিটি গঠন করে। সওজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম রেজাউল করিমকে প্রধান করে গঠিত দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গত জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়। ফেব্রুয়ারি থেকে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়। এরপর ৪৭টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জাল সনদ জমা দিয়ে কাজ পাওয়ার অভিযোগে তাদের কালোতালিকাভুক্ত করে সওজ। এরপর ঠিকাদারেরা আদালতে গিয়েও নিষেধাজ্ঞা তুলতে পারেননি। এখন সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরা আবার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে চাপ প্রয়োগ শুরু করেছেন।

সওজ সূত্র জানিয়েছে, কালোতালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো সড়কের ৯০ শতাংশের বেশি ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করত। যদিও সড়কে কাজ করা ঠিকাদারের মোট সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ১০০।

সূত্র আরও জানায়, সওজের তদন্তে পাঁচ ধরনের জালিয়াতি পাওয়া যায়। এগুলো হলো—১. জাল কর্মসম্পাদন সনদ জমা দেওয়া। অর্থাৎ যে ঠিকাদারি কাজ তারা করেনি, সেগুলোও উল্লেখ করেছে। ২. টাকার অঙ্কে কাজের পরিমাণ বেশি দেখানো। ৩. কাজ শেষ করেছে দেরিতে, কিন্তু দেখিয়েছে তারা যথাসময়ে কাজ করেছে। ৪. আর্থিক সক্ষমতা দেখাতে একটি দরপত্রে একই সনদ বারবার জমা দেওয়া। ৫. যৌথ উদ্যোগের ভুয়া তথ্য জমা দেওয়া।

কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো), স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), গণপূর্ত অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়েসহ বিভিন্ন সংস্থায় কাজের অভিজ্ঞতার সনদ জমা দিয়েছে, যার মধ্যে জাল সনদ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক, রেল ও সেতু বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিষয়টি অবগত আছেন। কোনো ঠিকাদার জালিয়াতি করে থাকলে তাঁকে নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই থাকতে হবে। চাপ দিয়ে কোনো লাভ হবে না।

 

এ ছাড়া এক বছর ধরে শুদ্ধি অভিযানের নামে যে ‘অশুদ্ধি’ অভিযান চালিয়েছে, তা বাতিল করতে হবে; জিওবি ফান্ড টেন্ডার ‘এ’ প্রাইজ অ্যাডজাস্টমেন্ট পদ্ধতি চালু করতে হবে; গত এক বছরে ৪৭ জন প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদারকে বেআইনিভাবে অযোগ্য ঘোষণার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে; বর্তমানে আহ্বান করা চলমান দরপত্র জরুরি ভিত্তিতে স্থগিত করতে হবে।

সওজের সূত্র বলছে, সওজের বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান দায়িত্ব নিয়েই জালিয়াতি করে কাজ পাওয়া ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেন। আর প্রকিউরমেন্ট সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আবুল কালাম আজাদসহ কিছু কর্মকর্তা প্রধান প্রকৌশলীকে কারিগরি সহযোগিতা দিয়েছেন। এখন জালিয়াতি করা ঠিকাদারেরা তাঁদেরই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছেন।

 

এমএএন

মন্তব্য করুন:

সম্পর্কিত খবর